বর্তমান সমাজে একটি পরিচিত ব্যধি পরস্পরের সাথে সম্পর্কের অবনতি। ধনী-গরীব, ছোট-বড় সবার মধ্যে এই বিষয়টি এমনভাবে প্রবেশ করছে যা থেকে সহজে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়। এই বিষয় নিয়ে আমরা চিন্তা করিনা, কোনো প্রয়োজন অনুভব করি না। সমাজের সবাই আমরা উচু থাকতে চাই, নিচু হতে পছন্দ করি না , হতেও চাইনা। সবাই সবাইকে নিয়ে এতো ব্যস্ত হয়ে আছি যে পাশের মানুষটাকে দেখার সময় নাই কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াতে সময় ঠিকই নষ্ট করছি। অহংকার আমাদের চারপাশে এমনভাবে ঘিরে আছে যা ভেদ করে বের হওয়া অনেক কষ্টসাধ্য ও সময়ের ব্যপার। জন্মের পর মানুষ প্রথম শিক্ষা গ্রহণ করে তার পরিবার থেকে তারপর সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কিন্তু কোথাও কি অহংকার সম্পর্কে কোন শিক্ষা দেওয়া হয় যা তার পরবর্তী জীবনে কাজে লাগে । অহংকারের কারণে ধর্মীয়ভাবে আমরা যেমন আমাদের ইবাদতগুলোর নির্যাস হারাচ্ছি তেমনি আমাদের পারিবারিক জীবনে অশান্তি বয়ে আনছি।
এ পোষ্টে যা আছে–
- অহংকার কি
- অহংকার সম্পর্কে কুরআনের সতর্কতা
- অহংকার পতনের মূল
- অহংকার সম্পর্কে হাদীসের সতর্কতা
- অহংকার নিজের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে কিনা তা যাচাই করার উপায়
- অহংকার থেকে বাঁচার উপায়
- গুরুত্বপূর্ণ কথা
অহংকার কি
অহংকার আরবি “কিবরু”র প্রতিশব্দ । হাদীসের পরিভাষায়- সত্যকে অস্বীকার করা,অন্যকে তুচ্ছ, নিকৃষ্ট মনে করা এবং নিজেকে অন্যের তুলনায় বড় মনে করাই অহংকার ।
এটা সকল পাপের মূল আর সে কারণে আরবিতে একে বলা হয়” উম্মুল আমরায” বা সকল রোগের জননী ।
অহংকার সম্পর্কে কুরআনের সতর্কতা
আল্লাহ তায়ালা কুরআনে সুস্পষ্টভাবে অহংকার সম্পর্কে বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখ করেছেন। কুরআন এমন একটি গ্রন্থ যা আমাদের জাগতিক ও আত্মিক শিক্ষা দিয়ে থাকে। কুরআন আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেতরে আত্মিক উন্নয়নে মূল ভুমিকা পালন করে থাকে। কুরআন বিহীন আমাদের জীবন জল বিহীন মাছের মতো। কুরআন যদি আমরা না পড়ি তাহলে আমদের জীবনের
আল্লাহ্ বলেন-
নিঃসন্দেহে তিনি অহংকারীদের মহব্বত করেন না।
সূরা নাহল ১৬:২৩
আবার আল্লাহ্ সূরা গাফের এ বলেন-
আল্লাহ্ এভাবেই প্রত্যেক দাম্ভিক অহংকারীর অন্তর মোহরযুক্ত করে দেন।
সূরা গাফের ৪০:৩৫
সূরা আরাফে আল্লাহ্ বলেন-
আমি আমার আয়াত ও নিদর্শনাবলী থেকে বিমুখ রাখবো ওই সব লোকদের যারা দুনিয়াতে না হক অহংকার করে।
সূরা আরাফ ৭:১৪৬
আল্লাহ্ সুবহানাতায়ালা আরো বলেন-
এই প্রকারে আল্লাহ্ তায়ালা প্রত্যেকটি অহংকারী ও গর্বিত লোকের অন্তরে মোহর লগাইয়া থাকেন।
সূরা মুমিন ৪০:৩৫
যদি কেউ নিজেকে আল্লাহ্র ওলী, বুজুর্গ বলে মনে করে তাহলে তাঁর জন্য খুবই খারাপ সংবাদ। তাঁর মনে অহংকার বসবাস করা শুরু করছে এটা দ্রুত সারাতে না পারলে দিন দিন বাড়তে থাকবে। অহংকারী ব্যক্তি প্রকৃত অর্থে আল্লাহ্র সাথে প্রভুত্ব নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকে। আর সে কারণে এটা এতো খারাপ গুন যা মানুষের ভালো আমলকে নষ্ট করে জাহান্নামের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
![](https://rezatang.com/wp-content/uploads/2023/11/নিঃসন্দেহে-তিনি-অহংকারীদের-মহব্বত-করেন-না।.jpg)
অহংকার পতনের মূল
ইবন জারীর বলেন-
আমাকে আবূ কুরায়ব, তাঁহাকে উসমান ইবন সাঈদ, তাঁহাকে বাশার ইবন আম্মারা, আবূ রউফ হইতে, তিনি যিহাক হইতে ও তিনি ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণনা করেন- ইবলীস ফেরেশতাদেরই একটি গোত্রভুক্ত ছিল। তবে তাহারা ছিল আগুনের সৃষ্টি। তিনি আরও বলেন, এই গোত্র ছাড়া অন্য সব ফেরেশতারা ছিলেন নূরের সৃষ্টি। কুরআনে বর্ণিত জীনরা অগ্নিশিখা হইতে সৃষ্টি। উহা ঊর্ধবগামী হয় এবং প্রজ্বলিত আগুন হইতে উদ্গত হয়।
পক্ষান্তরে , মানুষ মাটির সৃষ্টি। পৃথিবীতে প্রথম বাসিন্দা ছিল জীন জাতি। তাহারা পৃথিবীতে যখন চরম ফিতনা- ফাসাদ ও রক্তারক্তি সৃষ্টি করিল মারামারি কাটাকাটিতে লিপ্ত হইল, তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার ফেরেশতা বাহিনীর সঙ্গে সদলবলে ইবলীসকেও পাঠাইলেন। ইবলীসের দলও জীন ছিল। তাহারা যুদ্ধ করিয়া পৃথিবীর জীন জাতিকে ধ্বংস করিল এবং অবশিষ্টরা সমুদ্রের নির্জন দ্বীপে ও পাহাড়ের গুহায় পালাইয়া প্রাণ বাঁচাইল। এই বিজয় ইবলীসের মনে অহংকার সৃষ্টি করিল। সে মনে মনে ব্লিল,আমি যাহা ক্রিলাম তাহা কেহ কখনো কিরে পারে নাই। আল্লাহ্ তাঁহার মনের এই অবস্থা জানিতে পাইলেন। কিন্তু ফেরেশতাগনকে তাহা জানান নাই। ( তাফসীর ইবনে কাছীর-ই.ফা.বা-১ম খন্ড )
আল্লাহ্ আদমকে সৃষ্টি করার পর যখন ইবলীস ও তাঁর সঙ্গী ফেরেশতাগনকে হুকুম করলেন আদমকে সেজদা করার জন্য তখন ইবলীস ছাড়া সকল ফেরেশতা সেজদা করল কিন্তু ইবলীস অহংকার করে সেজদা করতে অস্বীকার করল। তাঁহার মনে অহংকার জন্মালো, আমি তো আদম হতে উত্তম আমি তাঁর বয়ঃজ্যেষ্ঠ এবং আগুনের তৈরী।
আল্লাহ্ কুরআনে বলেন-
![](https://rezatang.com/wp-content/uploads/2023/11/2-34-removebg-preview.png)
(আরো স্মরণ করো) যখন আমরা ফেরেশতাদের বলেছিলামঃ সাজদা করো আদমকে, তখন তাঁরা সবাই সাজদা করলো ইবলিস ছাড়া। সে (সাজদা করতে) অস্বীকার করলো, অহংকার করলো এবং সে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলো কাফিরদের।
সূরা বাকারা ২:৩৪
ইতিহাসে এরকম অনেক উদাহরণ পাওয়া যায় অহংকারের কারণে যাদের পরিণতি অনেক খারাপ হয়েছে।
আরও পড়ুন –
অহংকার সম্পর্কে কয়েকটি হাদীসঃ
আমরা হাদীস থেকে অহংকার সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করি যা আমাদের জীবনের জন্য সহায়ক হবে।
১।
![](https://rezatang.com/wp-content/uploads/2023/11/muslim_hadi_167-removebg-preview.png)
মুহাম্মদ ইবন মুসান্না, মুহাম্মদ ইবন বাশশার ও ইবরাহীম ইবন দীনার (র)… আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাস করল, মানুষ চায় যে, তার পোশাক সুন্দর হোক, তার জুতা সুন্দর হোক (এ-ও কি অহংকার) রাসূল বলেনঃ আল্লাহ্ সুন্দর, তিনি সুন্দরকে ভালবাসেন। অহমিকা হচ্ছে দম্ভভরে সত্য ও ন্যায় অস্বীকার করা এবং মানুষকে ঘৃণা করা।
সহীহ মুসলিম হা.১৬৭ (ই.ফা.বা) , তিরমিযী ১৯৯৮,১৯৯৯; আবু দাউদ ৪০৯১; ইবনু মাজাহ ৫৯,৪১৭৩; আহমাদ ৩৭৭৯,৩৯০৩,৩৯৩৭, ৪২৯৮।
২।
![](https://rezatang.com/wp-content/uploads/2023/11/muslim_hadi_6641-removebg-preview-1024x225.png)
আহমাদ ইবনে ইউসূফ আযদী(র)…… আবূ সাঈদ খুদরী ও আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ইযযত-সম্মান তাঁর (আল্লাহ্র) ভূষণ এবং অহংকার তাঁর চাদর। যে ব্যক্তি এই ব্যপারে আমার (অর্থাৎ আল্লাহ্র) সংগে জগড়ায় অবতীর্ণ হবে আমি তাকে অবশ্যই শাস্তি দিব।
সহীহ মুসলিম হা.৬৬৪১ (ই.ফা.বা) , সহীহ মুসলিম হা.৬৬৭৪ (তা.পা.)
৩।
![](https://rezatang.com/wp-content/uploads/2023/11/5368__2-removebg-preview.png)
আহমাদ ইবনু ইউনুস(র)…সালিম তাঁর পিতা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি অহংকারের সাথে নিজের পোশাক ঝুলিয়ে চলবে, আল্লাহ্ তাঁর প্রতি (রহমতের) দৃষ্টি দিবেন না কিয়ামতের দিন। তখন আবূ বকর (রা) বলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার লুঙ্গির এক পাশ ঝুলে থেকে, যদি তাতে গিরা না দেই। নবী সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নও, যারা অহংকার করে এরূপ করে ।
বুখারী শরীফ ৯ম খণ্ড হাদীস নং ৫৩৬৮ (ই.ফা.বা)
সহীহুল বুখারী শরীফ ৫ম খণ্ড হাদীস নং ৫৪৮৭ (তা.পা)
অহংকার নিজের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে কিনা তা যাচাই করার উপায়ঃ
১.আমি চাই সবাই আমাকে সালাম দিবে, আমি কাউকে সালাম দিতে চাই না সে যদি আবার আমার ছোট হয়।
২. আমার অতি সাধারণ পোশাকে লোক সমাজে বের হতে লজ্জা বোধ হয়।
৩. অন্যের সামনে নিজেকে ছোট মনে করা, পারিনা।
৪. কোনো অনুষ্ঠানে পিছনে বসা বা নীচে বসতে খারাপ লাগে।
অহংকার থেকে বাঁচার উপায়ঃ
১. বেশী বেশী মৃত্যুর কথা চিন্তা করা ।
২. সর্বদা জিকির করা।
৩. কাজ- কর্ম, কথাবার্তার মাধ্যমে বিনয়ী, নম্রতা হওয়া।
৪. গোপন আমল করা।
৫. মানুষকে ক্ষমা করা।
৬. ছোট কাজগুলো নিজে করা।
৭. ছোটবড় সবাইকে সালাম দেওয়া।
৮. সাধারণ পোশাক পরিধান করা।
৯. আল্লাহ্ নিকট বেশী বেশী ক্ষমা চাওয়া এবং কোন পাপ করলে সাথে সাথে তাওবা করা।
১০. আল্লাহর হেদায়াতের জন্য দোয়া করা ।
১১. দ্বীনদার মানুষের সাহচর্যে যাওয়া।
১২. আল্লাহকে চেনা।
গুরুত্বপূর্ণ কথাঃ
প্রশ্নঃ যদি কেউ আল্লাহ্র ইবাদত অন্যের চেয়ে বেশী করে তাহলে সে অন্যদের চেয়ে নিজেকে বড় মনে করতে পারবে?
উত্তরঃ না। কারণ ইবাদত কম বেশী এটা নিজের কোন কৃতিত্ব নেই সব আল্লাহ্র দয়া।
বিঃদ্রঃ জান্নাতে প্রবেশের আগে কেউ বলতে পারবে না, যে আমি অমুকের চেয়ে উত্তম। আল্লাহ্র শুকর আদায় করতে হবে এবং যারা এসব নিয়ামত পাননি তাদের জন্য দোয়া করতে হবে।
আমদের সবার উচিৎ অহংকারমুক্ত জীবনের জন্য আল্লাহ্র নিকট সাহায্য চাওয়া এবং জীবনের প্রতিটি কাজ আল্লাহ্র জন্য করা যাতে আল্লাহ্ আমদের উপর রাজি ও খুশি হন। আল্লাহ্ আমাদের সাবাইকে অহ্নকারমুক্ত জীবনের তাওফিক দান করুন।
অসাধারণ তথ্যবহুল লেখা ❤️শুভকামনা রইলো